Search This Blog

My Blog List

11.1.18

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন? আপনার সন্তান থেকে আপনি কী চান

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন? আপনার সন্তান থেকে আপনি কী চান ?
আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন?
আপনার সন্তান থেকে আপনি কী চান?


লেখকঃ আহমেদ রফিক
 


গাজিপুর থেকে ঢাকা ফিরছিলামবাসে উঠে বসলামকিছুক্ষন পর এক মুরব্বী উঠে আমার পাশেই বসলেনআমি সালাম দিলামস্নিগ্ধ কোমল চেহারাশ্বেত-শুভ্র লম্বা দাড়িদেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করেবয়সের ভারে বেশ ন্যুজ বোঝা যায়যেন জোর করেই লুকোনোর চেষ্টাকালো প্যান্ট সাদা শার্ট পরাইন করাহাতে একটি এক্সিকিউটিভ ফাইলকাগজ-পত্র ভরা
কিছুক্ষন পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা আপনার নাম? নাম বললামজিজ্ঞেস করলেন কী করেন? সংক্ষেপে বললামজিজ্ঞেস করলেন, কোথায় থাকেনবললামজানতে চাইলেন বাসায় কে কে আছে
বললাম, আলহামদু লিল্লাহ সবাই আছেবাবা-মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে
প্রশ্ন করলেন, ছেলে মেয়ে কটা? বললাম, আলহামদু লিল্লাহ আমার মোট ছয় ছেলে-মেয়েচারটা ছোট, আর দুজন বড়
মনে হয় তিনি পুরো কথাটা ধরতে পারেননিবললেন, কী বলছেন?
বললাম, হ্যা চাচা, আমার নিজের চার ছেলে-মেয়েদুই মেয়ে, দুই ছেলেআর বুড়ো দুই সন্তান হলেন আমার বাবা মা
জিজ্ঞেস করলেন, বাবা মা কি আপনার সাথেই থাকেন?
বললাম, সব সময় থাকেন নামানুষের ভীড়ে ঢাকা শহরে বাবার না কি দম বন্ধ হয়ে আসেউনি গ্রামেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেনতাই বাবা মা গ্রামেই থাকেনকিন্তু নাতীদের টানে আবার গ্রামেও তাদের মন টেকে নাতাই এখন এখানেই আছেনসারাক্ষন নাতী-নাতনীদের নিয়ে থাকেনদেখছি, এখানেই ওনারা বেশ আনন্দে আছেন আলহামদু লিল্লাহতাই আমিও ওনাদেরকে আর গ্রামে যেতে দিতে চাই নামাঝে-মধ্যে গ্রামের বাড়িঘর, জায়গা-জমি দেখা শোনার জন্য গিয়ে কিছু দিন থেকে আবার চলে আসবেন
বললাম, চাচা আপনি আমার বাবার চেয়েও বয়সে অনেক বড় হবেন মনে হয়আমাকে তুমি করে বলেনআপনার মুখে আপনিকরে শুনতে আমার আন-ইজি লাগছে
বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, থ্যাংক ইউ
কথা বলতে বেশ ভালোই লাগছিলো ভদ্রলোকের সাথেদেখলাম, উনি আর কিছু জিজ্ঞেস করছেন নাঅগত্যা আমিই জানতে চাইলাম ওনার কথাকী করেন, ছেলে-মেয়ে কটা, কী করে ইত্যাদি
ছেলে-মেয়েদের কথা বললেনবড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, অ্যামেরিকাতে থাকেমেঝ ছেলে এই দেশেরই একজন উপ-সচিবএর পর তার আরেকটি মেয়েও আছেসে যুক্তরাজ্যে স্বামীর সাথে থাকে; সেখানকার নাম করা একটি কলেজের শিক্ষকতিনি নিজে একটি সি.এ ফার্মে অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করেন
এরপর কিছুক্ষন নিরবে কেটে গেলোআমি মনে হয় অন্য কিছু চিন্তা করছিলাম, না যেন ফোনে কথা বলছিলাম
হঠাৎ ফিরে দেখলাম ভদ্রলোক চোখ মুছছেনপানি বেয়ে পড়ছে গণ্ড বেয়েআমি ভাবলাম, শরীরে কোনো আঘাত-টাঘাত পেয়েছেন হয়তোবললাম, চাচা কী হয়েছে? বললেন, কিছু না বাবা
আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লামকী করবো, কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম নাবললাম, চাচা কিছু মনে না করলে আমাকে বলুন কী হয়েছে? কিছুক্ষণ হাতের রুমালে চোখ চেপে রেখে, কী হয়েছে সেটা না বলে তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা-মা সত্যিই সৌভাগ্যবান
বললাম, আলহামদু লিল্লাহদোয়া করবেন, যেন আজীবন ওনাদের খিদমত করে যেতে পারি
আমি জিজ্ঞেস করলাম, চাচা আপনার এই বয়সে এভাবে বাসে দৌড়-ঝাপ করে চলাফেরা করতে কষ্ট হয় না? কেনই বা করেন? আপনার ছেলে-মেয়েরা তো সব সুপ্রতিষ্ঠিত, স্বচ্ছল!
বললেন, কষ্ট তো হয়ই বাবা, কিন্তু না করেও তো উপায় নেই!
বললাম, কেন, আপনার সন্তানরা…?
বললেন, তাদের সময় নেই খোজ খবর নেওয়ারতারা তাদের নিজেদের জীবন-ক্যারিয়ার নিয়ে এতো ব্যাস্ত যে সময়ই পায় নাটাকা-পয়সাও পাঠায় নাআমার তো স্ত্রী আছেআমার ও তার জীবনধারণের জন্য হলেও আমাকে এই বয়সে চাকুরি করতে হচ্ছেছেলে-মেয়েরা বলে, আমি বসে থাকলে নাকি অসুস্থ অচল হয়ে পড়বো, ডায়াবেটিক প্রেসারে আক্রান্ত হবোঅতএব আমার খেটে খাওয়া উচিৎ
আমি যেন বোবা হয়ে গেলামশান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম নাশুধু তাকিয়ে রইলাম কতোক্ষণঅসহায়ের মতোভাবছিলাম এই আধুনিক বস্তুবাদী সেক্যুলার সমাজব্যবস্থার কথাএখান থেকে কী তৈরি হচ্ছে! এতো মানুষকে জন্তু জানোয়ার বানানোর কারখানা হয়ে দাড়িয়েছে! কোথায় যাচ্ছি আমরা! কিসের পেছনে ছুটে চলছিকোথায় হারিয়ে গেলো আমাদের শান্তির সুখ পাখিটি? কোথায়? কে দায়ভার নেবে এই অসহায় বৃদ্ধার? কে তাকে শান্তনা দেবে? কে রুমালটা এগিয়ে দেবে অন্তত, তার চোখের জলটুকু মোছার?
বললাম, চাচা দোয়া করেন ছেলে-মেয়েদের জন্য, আল্লাহ ওদেরকে সঠিক বুঝ দান করবেনচাচা বললেন, দোয়া তো করি, কিন্তু দোয়া তো কবুল হচ্ছে না।. বললাম চাচা দোয়া করতে থাকেনদোয়া আল্লাহ নিশ্চয়ই কবুল করেন; যদি তা সঠিকভাবে হয়এই দেখুন, আমার বাবাকে আমি ছোট সময় থেকে দেখেছি, তিনি আল্লাহর কাছে কেবল একটিই দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার সন্তানকে খাটি মুসলিম বানাও, দ্বীনদার বানাওআমি কতোটুকু দ্বীনদার খাটি মুসলিম হতে পেরেছি তা জানি নাভুল-ত্রুটি, গুনাহ খাতা তো হর হামেশাই করে ফেলিকিন্তু বাবা-মায়ের খেদমত করার চেষ্টা করি আপ্রানএটা শুধু বাবা-মার সন্তুষ্টির জন্যই যে করিতা নয়; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করি মুলতকারণ আমার দ্বীন, আমার ইসলাম আমাকে এটা শিখিয়েছে চাচাআমার দ্বীনই আমাকে শিখিয়েছে যে, বাবা মা যে সন্তানের উপর সন্তুষ্ট নয় আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট নন
দেখুন চাচা, আমার বাবা অনেক পয়সাওয়ালা মানুষ ছিলেন নাঅনেক আবদারই অনেক সময় পুরণ করতে পারেন নিতথাকথিত নামি-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও লেখা-পড়া করাতে পারেননি হয়তোসামর্থ্যে যতোটুকু ছিলো চেষ্টা করেছেনআমি হয়তো অ্যামেরিকান কোনো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হয়নি, অন্তত বাবা-মার চক্ষু-শীতলকারী সন্তান হতে পেরেছি, আলহামদু লিল্লাহআল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন আজীবন ওনাদের চক্ষু শীতলকারী হয়ে থাকতে পারি
চাচা অপলক তাকিয়ে আছেনবললাম, চাচা, আপনার দোয়াও নিশ্চয়ই কবুল হয়েছেআপনি মনে করুন তো, আপনার সেই তরুণ বয়সের কথাযখন আপনার সন্তানগুলো জন্মগ্রহণ করেছিলোআপনি তাদের লেখা-পড়া, ভবিষ্যত নিয়ে কতো চিন্তিতো ছিলেন! কতো উদ্বিগ্ন! দোয়া কি করতেন না তখন? অবশ্যই করতেনমনে করুন তো কী দোয়া করতেন?
يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا أَصَابَكَ ۖ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ
''হে আমার পুত্র, নামায কায়েম করো, আর সৎকাজের নির্দেশ দিয়ো ও অসৎকাজে নিষেধ করো, আর তোমার উপরে যাই ঘটুক তা সত্ত্বেও অধ্যবসায় চালিয়ে যাওনিঃসন্দেহ এটিই হচ্ছে দৃঢ়সংকল্পজনক কার্যাবলীর মধ্যেকার(সূরা লুকমান ১৬)
চাচা বললেন, হ্যা বাবা! দোয়া করতাম তারা যেন বড় হয়, শিক্ষিত হয়সমাজে আমার মুখ উজ্জ্বল করেসম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারে
বললাম, চাচা দেখেন, আপনার দোয়া কিন্তু কবুল হয়েছে! আপনি যা চেয়েছিলেন তা কিন্তু হয়েছেতারা বড় শিক্ষিত হয়েছে, সমাজে আপনার মুখও উজ্জ্বল করেছেভালো করে মনে করে দেখেন চাচা, আপনার সন্তানদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে কিন্তু আপনি গুরুত্ব দেননিতাদেরকে মহান স্রষ্টা আল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়াকে গুরুত্ব দেননিকখনো হাত তুলে এই বলে কান্নাকাটি করেননি যে, হে আল্লাহ! তুমি আমার সন্তানদেরকে ভালো দ্বীনদার বানাও, ভালো মুসলিম বানাও, ঈমানদার বানাওকখনো বলেননি, রব্বানা, হাব লানা মিন আযওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা কুররাতা আইউন, ওয়াজ আলনা লিল মুত্তাকীনা ইমামা
চাচা দেখুন, আমরা যারা পিতা-মাতা, আমরা কিন্তু দাতা নই, আয়োজক মাত্রআমরা আমাদের সন্তানদেরকে খাদ্য-খাবার, পোষাক আশাক যা কিছুই দেই না কেন, আমরা কিন্তু নিছক ব্যবস্থাপকমুল দাতা হলেন মহান দয়ালু ও রিজিকদাতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাআমরা যদি মুল মালিকের প্রতি তাদেরকে কৃতজ্ঞ হতে না শিখাই, তাহলে কিভাবে আশা করতে পারি যে, তারা আমাদের প্রতি শেষ পর্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকবে?
চাচা এই যে বৃদ্ধ বাবা-মার যত্ন না নেওয়া এটা কি মানবতার জন্য একটি বিপর্যয় নয়?
চাচা বললেন, এটা শুধু বিপর্যয় নয়, মহা বিপর্যয়এটা মানুষত্যের মর্যাদা থেকে মানুষের পশুর পর্যায়ে নেমে যাওয়ার নামান্তর
এই অসভ্যতা কোত্থেকে আমাদের মুসলিম সমাজে এসেছে জানেন চাচা? এসেছে বস্তুবাদীতা থেকে, পশ্চিমা অসভ্যতা থেকেমুসলিম দেশে কখনো কোনো মানুষ পালার খোয়াড় ছিলো নাআজ আমরা তাদেরকে আমাদের চরম পরম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিআমাদের দেশেও এখন এই খোয়াড় ব্যবস্থা এসেছেগুড়োদের খোয়াড়, বুড়োদের খোয়াড়বাংলায় বললে কেমন যেন অসভ্যতা নগ্ন হয়ে ধরা পড়ে যায়তাই আদুরে নামে এরা ইংলিশে বলে ডে কেয়ারবা ওল্ড হোম।. শিশুকালে আপনি সন্তানকে ডে কেয়ারে রাখবেন, বুড়ো হলে তারা আপনাদেরকে ওল্ড হোমে রেখে আসবে
দ্বীনদার না হওয়া সত্ত্বেও অনেকে হয়তো মানবিক বোধ থেকে বাবা মার খোজ-খবর রাখতে পারেন, দেখা-শোনা করতে পারেনকিন্তু একজন দ্বীনদার সন্তানের কাছ থেকে বাবা সত্যি কেমন আদর-যত্ন ও সম্মান শ্রদ্ধা পেতে পারেন তা কেবল সেই বাবা-মারাই জানেন, যাদের দ্বীনদার সন্তান আছে
ঢাকায় আমি আমার স্টপেজের কাছে এসে চাচার কাছ থেকে বিদায় নিলামবললাম, চাচা আপনি মুরব্বী মানুষ, অনেক কথা বলেছি, ভুলত্রুটি মাফ করে দিয়েনচাচার চোখ আবার ছলছল করে উঠলোক্ষণিকের পরিচয়ে মনে হয় অনেক আপন হয়ে পড়েছিলামবাস থেকে নেমেও দেখলাম, চাচা তাকিয়ে আছেন জানালা দিয়েআবারো হাত নাড়লামদোয়া করলাম, হে আল্লাহ! তুমি ভালো রেখো চাচাকে
وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَىٰ وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ
আর আমরা মানুষকে তার পিতামাতার সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি -- তার মাতা তাকে গর্ভে ধারণ করেছিলে কষ্টের উপরে কষ্ট করে, আর তার লালন-পালনে দুটি বছর, -- এই বলে -- ''আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করোআমারই নিকটে প্রত্যাবর্তনস্থান
(সূরা লুকমান ১৪)
এ সমস্যা শুধু বাসে দেখা হওয়া এই চাচারই নয়তিনি এই সমাজের একটি দর্পনমাত্রআমি এমন আরো অনেক দেখেছিআপনিও দেখেছেন নিশ্চয়ই অনেকআপনার একই বিল্ডিং এ, পাড়ায়, মহল্লায়, আত্মিয় ও বন্ধু বান্ধবের পরিবারেমাতাল, হিরোইন, গাজা, ডাইল সহ নানা রকম মাদকসেবী সন্তানদের ঘটনা তো অহরহ দেখবেন আপনার চারপাশে